স্পোর্টস ডেস্কঃআর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। বহুল প্রত্যাশিত চ্যাম্পিয়নস ট্রফির দামামা বেজে ওঠার অপেক্ষায় আছে পুরো ক্রিকেটবিশ্ব। ১ জুন বৃহস্পতিবার ইংল্যান্ড-বাংলাদেশ ম্যাচ দিয়ে শুরু হচ্ছে ক্রিকেটের মিনি বিশ্বকাপ খ্যাত এই টুর্নামেন্ট।
ব্যাট-বলের মূল লড়াই শুরুর আগে চলুন ফিরে দেখা যাক এই লড়াইয়ের শুরু থেকে বর্তমান।
আইসিসি নক আউট ট্রফি ১৯৯৮
১৯৯৮ সালে শুরু হয় চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। এই টুর্নামেন্টের প্রথম দিকের নাম ছিল ‘আইসিসি নক আউট ট্রফি’ । আর সেই আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশে হওয়া এই আসরে নিসন্দেহে সেরা দল ছিল তারা।
ঢাকায় ২৪ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত প্রথম আসরের শিরোপা জয় করে দক্ষিণ আফ্রিকা। দলটির জন্য এটিই প্রথম ও শেষ আইসিসি ইভেন্টের শিরোপা জয়।
হ্যান্সি ক্রনিয়ের নেতৃত্বাধীন প্রোটিয়ারা সেমিফাইনালে বৃষ্টি আইনে শ্রীলঙ্কাকে ৯২ রানে হারিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত করে। এরপর জ্যাক ক্যালিসের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে উদ্বোধনী আসরের শিরোপা ঘরে তোলে দক্ষিণ আফ্রিকা। তিন ম্যাচে ১৬৪ রান ও ৮ উইকেট শিকার করে ম্যাচ ও টুর্নামেন্ট সেরা হন ক্যালিস।
আইসিসি নক আউট ট্রফি ২০০০
দ্বিতীয় আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় নিউজিল্যান্ড। সেবারও আগের নামেই থেকে গেছে এই টুর্নামেন্ট। শুধু পাল্টে গিয়েছিল আয়োজক দেশ (কেনিয়া) এবং চ্যাম্পিয়ন। ক্রিকেট বিশ্বে কিউইদের একমাত্র সাফল্যের টুর্নামেন্ট ২০০০ সালের এই আসর।
ফাইনালে সৌরভ গাঙ্গুলির ১১৭ রানের একটি ঝলমলে ইনিংসের খেলেন। কিন্তু এরপরও ক্রিস কেয়ার্নসের অপরাজিত ১০২ রানের সুবাদে প্রথমবারের মত আইসিসির কোনো ইভেন্টের শিরোপা জয় করে কিউইরা। টুর্নামেন্ট চলাকালে কিউইদের বেশ কয়েকজন তারকা খেলোয়াড় ইনজুরিতে পড়ায় এ শিরোপা জয় নিউজিল্যান্ড দলে ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়। ইনজুরির কারণে কেয়ার্নস, ড্যানিয়েল ভেট্টরি এবং ডিওন ন্যাশ সেমিফাইনাল খেলতে পারেননি। তবে অন্যরা ঠিকই দাঁড়িয়েছেন, যে কারণে তাদের শিরোপা জয়। অবশ্য টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি রান আর বেশি উইকেট লাভ করে দুই ভারতীয়।
আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ২০০২
তৃতীয় আসরে এসে এই টুর্নামেন্টের নাম পাল্টে হল আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। আগের আসরের রানার্স-আপ দল এবার চ্যাম্পিয়ন হলো, তবে এককভাবে নয়, যৌথভাবে। ফাইনালের দিন বৃষ্টি বাগড়া দিলে রিজার্ভ ডে’তে খেলা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ‘দ্বিতীয়’ ফাইনালের দিনও বৃষ্টি, ফলে যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয় ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে । আয়োজক শ্রীলঙ্কার জন্য এটি কষ্টের যে তারা এককভাবে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি, কিন্তু তারা হয়তো কিছুটা ধন্যবাদ দিয়েছে, কারণ দুইদিনই তারা ব্যাকফুটে ছিল।
ভারতের বীরেন্দার শেবাগ টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ ২৭১ রান করেন। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ ১০ উইকেট শিকার করেন শ্রীলঙ্কার মুত্তিয়া মুরালিধরন।
আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ২০০৪
২০০৪ সালের ৪র্থ আসরে দলসংখ্যা বাড়িয়ে আইসিসি এই টুর্নামেন্টে অনেক পরিবর্তন আনে। পূর্ণ ১০ সদস্যসহ কেনিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে, মোট ১২ দলের টুর্নামেন্ট হয় আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির এই আসরে । ১২টি দলের অংশগ্রহণে ৫ ম্যাচের আসরটি চলে ১৫ দিন। ফাইনালে স্বাগতিক ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ মুখোমুখি হয়। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবার আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা জয় করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ২০০৬
ক্রিকেট বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ছিল তখন অস্ট্রেলিয়া। নিসন্দেহে টুর্নামেন্টের ফেভারিটও ছিল তারা। আর সে সময়ের অস্ট্রেলিয়া দলটি ছিল বিধ্বংসী মেজাজের জন্য পরিচিত। কিন্তু এ আসরে আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিস গেইল। এক আসরেই ৪৭৪ রান করে বিশ্বকে তার চমকের কথা জানান দিয়েছিলেন ক্রিস গেইল। আগের আসরে অভিষেক হয়েছিল, কিন্তু সে আসরে খুব একটা সফল হতে পারেননি। তাই এই আসরে তা সুদে-আসলে তুলে নিয়ে এক আসরের সর্বোচ্চ রান-সংগ্রহকারী বনে যান। আরেক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান জেরোমি টেলরকেই এক আসরে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার হয়ে যান ১৩ উইকেট নিয়ে। এই আসরে ব্যক্তিগতভাবে ছড়ি ঘুরিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটাররা, কিন্তু দলীয়ভাবে সফলতা পেয়েছে অসিরা । আর ২০০৬ সালের এ আসরের মাধ্যমেই বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে নিজেদের আধিপত্যের প্রভাবটা আরও বাড়িয়ে নেয় অস্ট্রেলিয়া।
টুর্নামেন্ট ছিল বিতর্কে ঢাকা। নিষিদ্ধ ঘোষিত শক্তিবর্ধক মাদক ব্যবহারের কারণে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে পাকিস্তানী ফার্স্ট বোলার শোয়েব আখতার ও মোহাম্মদ আসিফকে নিষিদ্ধ করা হয়। এই আসরেই বাংলাদেশ শেষ খেলার সুযোগ পেয়েছিল।
আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ২০০৯
২০০৭ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নরা ২০০৯ সালের দক্ষিণ আফ্রিকার আসরেও দাপট দেখিয়ে জিতে নেয় শিরোপা। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ২০০৮ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ আসর এক বছর পিছিয়ে দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেয় আইসিসি। প্রতিবেশী দেশ নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা আরও একবার দখল করে নেয় অস্ট্রেলীয়রা।
মাইকেল ক্লার্ক, ব্র্যাড হাডিন এবং নাথান ব্র্যাকেনের অনুপস্থিতিতে কাজটি অস্ট্রেলিয়ার জন্য মোটেই সহজ ছিল না। তবে রিকি পন্টিংয়ের অসাধারণ নেতৃত্ব ও মিচেল জনসন, পিটার সিডল এবং টিম পাইন অস্ট্রেলিয়া দলকে চ্যাম্পিয়নের তকমা জুড়ে দেয়।
আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ২০১৩
গুঞ্জন ছিল ২০১৩ সালে আয়োজিত হচ্ছে শেষ আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। আয়োজক দেশ ইংল্যান্ড আর ওয়েলস। তাই এমএস ধোনির ভারত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর সবাই ধরেই নিয়েছিল যে একাধারে বিশ্বকাপ, আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ও ওয়ার্ল্ডকাপ টি-টোয়েন্টি জেতা একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে ধোনি থেকে যাচ্ছেন। পুরো টুর্নামেন্টে ভারত দাপট দেখিয়ে শুরু করেছিল। গ্রুপ-পর্বে কোনো ম্যাচে না হেরেই সেমিফাইনালে উঠে তারা। তারপর কার্ডিফের সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ফাইনালে।
আবহাওয়া অবশ্য এবারও ভারত আর এই সিলভার ট্রফিটার মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত ফাইনাল ম্যাচটা হয়। তবে সেটা ওয়ানডে টুর্নামেন্টের ফাইনালের চেয়ে ২০ ওভারের ক্রিকেট-টুর্নামেন্টের ফাইনালও বলা যায়। ইংল্যান্ড আর ভারত দুই দল মিলিয়ে খেলা যে হল মাত্র ৪০ ওভারের। আর তাতে মাত্র ১৩০ রানের টার্গেট দিয়েও ভাগ্যক্রমে চ্যাম্পিয়ন হল ভারত।
মধ্যবিরতিতে যেখানে মনে হচ্ছিল ইংল্যান্ড এই রান কত ওভার বাকি থাকতেই টপকে যায় সেটাই দেখার বিষয়, সেখানেও এই রানটাই অনেক বড় বানিয়ে দিল ভারতীয়রা। আর সেখানে সবচেয়ে বড় নাম ইশান্ত শর্মা । পুরো ম্যাচে যথেষ্ট মার খেলেও ইনিংসের ১৮তম ওভারের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা ওভার করার জন্য ভারতীয় অধিনায়ক তার ওপরই ভরসা রেখেছিলেন, আর এর প্রতিদানটা কত ভালভাবেই না দিলেন। মরগান আর বোপারাকে আউট করেই কাজের কাজটা করেন ইশান্ত শর্মা । পরের দুই ওভারে জাদেজা-অশ্বিনের অসাধারণ বোলিংয়ে আটকে গেল স্বাগতিকরা।
এবারের আসর
গুঞ্জন-টুঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে শুরু হতে চলেছে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির অষ্টম আসর। অতীত সফলতা-ব্যর্থতা পাশে রেখে আবারো নেমে পড়ছে টুর্নামেন্টের জন্য নির্বাচিত ৮ দল । আশার কথা এই ৮ দলের মধ্যে আছে বাংলাদেশও । ২০১৫ বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশ দলকে দেখে ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার গ্রুপে পড়লেও ভাল কিছু করার আশা আমরা করতেই পারি । যথেষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ একটি দল নিয়ে মাশরাফিরা এবার যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমাচ্ছে । আমরা তাকিয়ে আছি তামিম-সৌম্য-সাব্বির-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ-সাকিব-মাশরাফিদের দিকে । ভাল ফল আনবেই আমাদের সোনার ছেলেরা। দ্বিপক্ষীয় সিরিজে একের পর এক সফলতা অর্জন করলেও বৈশ্বিক কোনো টুর্নামেন্ট এখন পর্যন্ত জেতা হয়নি। বেশ কয়েকবার ভাল কিছু করেও শেষ হাসিটা হাসা হয়নি এখনও। কিন্তু তাতে কী! চেষ্টাটা আরেকবার করেই দেখা যাক-না!