নিউজ ডেস্ক : জ্যৈষ্ঠের তাপদাহে পুড়ছে দেশ। প্রকৃতি ছাড়ছে তপ্ত নিঃশ্বাস। মাথার ওপরের নীল আকাশটা যেন তাঁতালো কড়াইয়ের রূপ নিয়েছে। সূর্যরশ্মী যেন শরীরে বিধছে আগুনের হলকার মতো। তাপমাত্রার পারদ কেবল ওপরেই উঠছে।
বাইরে গেলে গরম। বাসায় আসলে গরম। কোথাও গিয়ে শান্তি নেই। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা থেকে শান্তির জন্যই সবাই নীড়ে ফিরে। কিন্তু সেখানে গিয়েও শান্তি নেই। কীভাবে থাকবে বলুন? বিদ্যুতই তো থাকছে না। বিকাল থেকেই আসা যাওয়ার মধ্যেই যেন লুকালুকি খেলছে বিদ্যুৎ। আসছে একটু জানান দেওয়ার জন্য যে বিদ্যুৎ বলে কিছু একটা আছে। এক চরম ভোগান্তিতে দিন কাটছে মানুষের।
সরকার থেকে বলা হচ্ছে দেশে বিদ্যুতের কোনো ঘাটতি নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, ‘সরকার মাত্র ৫ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন তিনগুণ বৃদ্ধি করে ২০১৩ সালে ১ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করে। দ্বিতীয় মেয়াদে মাত্র ৩ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ হাজার ৩৫১ মেগাওয়াটে উন্নীত করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বিষয়ক সরকারি সংগঠন পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৯ হাজার ২১২ মেগাওয়াট। আর ৮০ শতাংশ মানুষ এই বিদ্যুৎ উপভোগ করছে। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে লক্ষ্যমাত্রা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি হয়ে থাকলে কোথায় সেটি? আর কেনই বা এত লোডশেডিং?
আবার লোডশেডিংয়ের কারণে কোথাও কোথাও পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। এতে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। তার ওপর গ্যাসের তীব্র সঙ্কটতো আছেই। গ্যাস পাম্পে গ্যাস নেই। আর থাকবেই বা কিভাবে? বিদ্যুৎ তো নেই।
পল্লী বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিং মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। অসহায় হয়ে পড়েছেন সেচের সঙ্গে জড়িত কৃষকরা। এদিকে, লোডশেডিং ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে শিল্প উত্পাদন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যান্ত্রিক ও ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী বিকল হচ্ছে। গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশু ও বৃদ্ধরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, গ্যাস সরবরাহে স্বল্পতার কারণে বিদ্যুতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানায়, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা আছে ১৩ হাজার ১৭৯ মেগাওয়াট। কিন্তু গত ১০ই এপ্রিল পিক আওয়ারে সন্ধ্যা ৭টায় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে আট হাজার ৯৬৮ মেগাওয়াট। সারাদেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ধরা হয়েছিল একই পরিমাণ মেগাওয়াট। কাগজে-কলমের এই হিসাবে দেশে বিদ্যুতের কোনো লোডশেডিং নেই। এটা সরকারি হিসাব। কিন্তু সারা দেশে বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার আচরণ বলে দেয় কি পরিমাণ লোডশেডিং হয়। শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে। কিন্তু সে সময় লোডশেডিং এর বালাই নেই।
এদিকে, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছেন, আগামী চার দিনের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকা এবং উৎপাদনের কাঁচামাল গ্যাসের স্বল্পতাকে এর মূল কারণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যেখানে বিদ্যুৎ উৎপানেই স্বল্পতা সেখানে এতো কম সময়ে সমাধান সম্ভব কি আদৌ?
বাংলাদেশ আবহাওয়া অফিস থেকে গতকাল সোমবার বলা হয়েছে, এই তাপপ্রবাহ আরও কয়েক দিন অব্যাহত থাকতে পারে। ২৫ অথবা ২৬ মের আগে অন্তত ঢাকায় জোরালো বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অফিসের সূত্র মতে, ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল এবং চাঁদপুর, রাজশাহী ও পাবনার উপর মৃদু তাপপ্রবাহ বইছে। গতকাল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৬ ডিগ্রি আর সর্বনিম্ন ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজশাহীতে ছিল সর্বোচ্চ ৩৭.৫ ডিগ্রি ও সর্বনিম্ন ২৮.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, খুলনায় সর্বোচ্চ ৩৮ ডিগ্রি ও সর্বনিম্ন ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বরিশালে সর্বোচ্চ ৩৭ ডিগ্রি ও সর্বনিম্ন ২৮.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ রাশেদুজ্জামান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এই সময় দক্ষিণ দিক থেকে আসা বাতাসে প্রচুর জলীয়বাষ্প থাকে। সূর্যের প্রখরতা বেশি থাকে। এসব কারণে গরমে অস্বস্তিবোধ বেড়ে যায়।
পৃথিবীর তাপাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে মেরু অঞ্চলের ও পর্বতের বরফ গলতে শুরু করেছে। এতে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা এভাবে তাপমাত্রা ও সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়তে থাকলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল খুব ডুবে যেতে পারে। তবে এটা পরিলক্ষিত যে বাংলাদেশে এখন অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টিসহ জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ঘন ঘন ঘটার মূল কারণই হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১.৮ ডিগ্রি থেকে ৬.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো বাড়তে পারে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ০.৫ মিটার বাড়বে এবং বাংলাদেশে উচ্চ মাত্রায় জনসংখ্যা অধ্যুষিত উপকূলীয় এবং বদ্বীপ এলাকাসমূহে ব্যাপক প্লাবনের আশঙ্কা আছে। হারিকেন, ঘূর্ণিঝড়, খরাসহ জলবায়ুগত দুর্যোগগুলো ঘনঘন দেখা দেবে এবং এদের তীব্রতা বেড়ে যাবে। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে ম্যালেরিয়া, কলেরাসহ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগগুলো বিষুবরেখা অঞ্চলের উত্তর ও দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়তে পারে।