নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে রাষ্ট্রপতির গঠিত সার্চ কমিটি দেশের চার বিশিষ্ট নাগরিককের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের মতামত নিয়েছে। দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে সামর্থ্যবান একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে চান। একইসাথে সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই নির্বাচন কমিশন গঠন হবে, এর বাইরে কিছু হবে না- এমনটাই প্রত্যাশা এসব বিশিষ্ট নাগরিকদের। সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে যে কমিশন হবে সেটা বাংলাদেশে নির্বাচনের ক্ষেত্রে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে বলেও তারা মনে করছেন।
এদিকে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে চার বিশিষ্ট নাগরিকের মতামত নেয়ার পর বৃহস্পতিবার আবার বৈঠকে বসছেন রাষ্ট্রপতির গঠিত সার্চ কমিটির সদস্যরা। বুধবার সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে চার বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে সার্চ কমিটির মতবিনিময়ের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও বিধি) আব্দুল ওয়াদুদ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় এই জাজেস লাউঞ্জেই আবার বসবেন সার্চ কমিটির ছয় সদস্য।
এরআগে সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে সকাল ১১টায় বৈঠক শুরু হয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা চলে। বৈঠকে চার বিশিষ্ট নাগরির সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে সার্চ কমিটির সদস্য হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, মহাহিসাব নিরীক্ষক (সিএজি) মাসুদ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজরুল ইসলাম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভিসি ড. শিরীণ আখতারও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
আমন্ত্রণ পাওয়া চার বিশিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে সাবেক সিইসি মোহাম্মদ আবু হেনা সবার আগে বৈঠকস্থলে পৌঁছান। এরপর পর্যায়ক্রমে আসেন সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ। এই জাজেস লাউঞ্জেই গত সোমবার সার্চ কমিটি দেশের ১২ বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে তাদের মতামত নেয়। এরা হলেন- হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুর রশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এসএমএ ফায়েজ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক, সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নির্বাহী বদিউল আলম মজুমদার। বৈঠকে তারা নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে দক্ষ, সৎ, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় ব্যক্তিদের নাম সুপারিশ করার জন্য রাষ্ট্রপাতির গঠিত সার্চ কমিটিকে পরামর্শ দেন। ওইদিনই আরও পাঁচজনকে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু অর্থ আত্মসাতের মামলার আসামি হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার পর আমন্ত্রিতদের তালিকা থেকে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুর রশীদের নাম বাদ দেয় সার্চ কমিটি।
বৈঠক শেষে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের আবু হেনা বলেন, সার্চ কমিটি সুশীল সমাজের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময়ের যে উদ্যোগ নিয়েছেন এটা খুব শুভ পদক্ষেপ। এটা কনটিনিউ করা উচিত। সার্চ কমিটির নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন আছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না, তাদের অন্যভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেন, অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে বৈঠক হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি সার্চ কমিটি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে। যোগ্য সার্চ কমিটি হয়েছে। তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। আশা করি তারা রাষ্ট্রপতির কাছে যোগ্য নামটি পাঠাবে। তিনি বলেন, সার্চ কমিটিকে সৎ, যোগ্য ও সাহসী লোকের নাম পাঠানোর বিষয়ে মত দিয়েছি। আমি বলেছি, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যার সামান্য বিরোধ আছে তাকে নির্বাচন কমিশনের কোনো দায়িত্ব দেয়া যাবে না। এ কথাটি আমরা জোর দিয়ে বলেছি।
গোলাম সারওয়ার বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হলো চিফ ইলেকশন কমিশন। তিনি দৃঢ় হলে সব ঠিক। আমরা দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছি ভারতের নির্বাচন কমিশনের কথা। সেখানকার নির্বাচন কমিশন কারও কথা মানে না। মেরুদন্ড সোজা থাকতে হবে নির্বাচন কমিশনের। তাদের বয়স অবশ্যই ৭০ এর মধ্যে থাকতে হবে। তিনি বলেন, সার্চ কমিটিকে বলেছি আমরা যে সুপারিশ করেছি তা যেন লিপিবদ্ধ করা হয় এবং তা যেন পরবর্তী নির্বাচন কমিশনকে দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতির ওপর আমাদের আস্থা আছে। এই প্রথম সুশীল সমাজকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমেরও ভূমিকা আছে। এজন্য তিনি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘আগামী নির্বাচনের ওপর নির্ভর করবে দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ কেমন হবে। ফলে নির্বাচন কমিশনে যোগ্য, সৎ ও সাহসী লোক নিয়োগ করতে হবে। তিনি বলেন, আমি মনে করি ঐতিহাসিকভাবে ইলেকশন কমিশনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সুষ্ঠু নির্বাচনে কমিশনের গুরুত্ব অনেক। সার্চ কমিটির একটা ভিশন থাকা উচিত। উনাদের যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারা তা সুষ্ঠুভাবে পালন করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে সরকারি দল যাতে কোনো হস্তক্ষেপ না করে। সার্চ কমিটি রিপোর্ট জমা দেয়ার সময় নাম প্রস্তাবের আগে একটি ভূমিকা রাখবেন। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে উনারা কিছু বক্তব্য দিয়েছেন। তা হয়ত উনাদের কার্যপরিধির মধ্যে পড়ে না। তবুও তা রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করবেন। যদি সম্ভব হয় ভবিষ্যতে এটা ফলো করা যেতে পারে। রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, সার্চ কমিটি আমাদের চাহিদা অনুযায়ী কিছু লোক সিলেক্ট করলেন। সেই ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির মনোনীত হওয়ার পর ফেইল করলে সার্চ কমিটিকে দোষারোপ করা চলবে না। তিনি আবু হেনা ১৯৯৬, আবু সাঈদ ২০০১ এবং শামসুল হুদা ২০০৮ সালে যে নির্বাচন করেছেন সেটাকে দৃষ্টান্তমূলক হিসেবে দেখছেন। তবে তার মতে আগামী নির্বাচনে যে কমিশন থাকবে এই তিনজনের সঙ্গে তাদের একটা পার্থক্য আছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, উনারা নির্বাচন করেছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। আর নতুন কমিশন নির্বাচন করবে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে। এজন্য নতুন নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। নির্বাচন কমিশন নিয়ে আইনের ব্যাপারে তিনি বলেন, অনেক বিষয়েই আইন করা দরকার। কমিশনারদের কী কী যোগ্যতা থাকবে সেটাও আইনে থাকা দরকারি। আমরা ধরে নিয়েছি সার্চ কমিটি যে নাম দেবে এর বাইরে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবে না। কিন্তু যদি যায় তাহলে কী হবে? এটাও একটি বিষয়।
রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, আমাদের সবার প্রত্যাশা হলো সার্চ কমিটির সবচেয়ে বড় সাকসেস হবে, তারা যে নাম প্রস্তাব করবে এর বাইরে কিছু হবে না। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো কে সিইসি হবেন। তার নামের ওপর সবকিছু নির্ভর করে। তাছাড়া নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না এটা প্রত্যাশা। আর সার্চ কমিটির প্রস্তাবের আলোকেই রাষ্ট্রপতি নতুন কমিশন গঠন করবেন বলেও আশা করেন প্রবীণ এই আইনজীবী।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ইসি গঠন নিয়ে সংলাপে যোগ দেয়া ৩১টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৫টির কাছ থেকে নামের প্রস্তাব পাওয়ার পর মঙ্গলবার সেখান থেকে ২০ জনের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করেন সার্চ কমিটি। তবে এই ২০ জনের মধ্যে কারা আছেন, সে তথ্য প্রকাশ করেনি সার্চ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেয়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানিয়েছেন, আরো যাচাই-বাছাইয়ের পর ২০ জনের তালিকা থেকে দশজনকে চূড়ান্ত করবে সার্চ কমিটি। সেই দশজনের নাম ৮ ফেব্রুয়ারির মধে প্রস্তাব করা হবে রাষ্ট্রপতির কাছে। সার্চ কমিটির ওই সুপারিশের মধ্যে থেকে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যূন পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেবেন।
কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি দায়িত্ব নেবে নতুন কমিশন। তাদের অধীনেই ২০১৯ সালের শুরুতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে।
Check Also
সংরক্ষিত মহিলা আসনে কারো সঙ্গে জোট করবে না জাপা
সংবাদবিডি ডেস্ক ঃ দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের নির্বাচনে কারো সঙ্গে জোট করবে না …