নিউজ ডেস্ক:প্রতি গিগাবাইট ইন্টারনেট ডাটা কিনতে সেলফোন অপারেটরদের ব্যয় হয় গড়ে ২৬ পয়সা। অথচ গ্রাহকের কাছে একই পরিমাণ ডাটা ২০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি করছে অধিকাংশ অপারেটর। এতে ব্যান্ডউইডথের দাম দফায় দফায় কমানো হলেও তার সুফল পাচ্ছে না গ্রাহক। যদিও অপারেটরদের দাবি, ব্যান্ডউইডথের যে দাম তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে নেয়, তা তাদের ডাটাভিত্তিক সেবার মোট ব্যয়ের ১-৩ শতাংশের বেশি নয়।
জানা গেছে, সেলফোন অপারেটররা ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) থেকে প্রতি মেগাবিটস পার সেকেন্ড (এমবিপিএস) ব্যান্ডউইডথ কিনছে ৩৯০ থেকে ৫৫০ টাকায়। এক এমবিপিএস গতির সংযোগে মাস শেষে ডাটা ব্যবহারের পরিমাণ দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫৯২ গিগাবাইট (জিবি)। এ হিসাবে প্রতি জিবি ডাটা কিনতে অপারেটরদের ব্যয় হয় ১৫-২১ পয়সা। তবে সংযোগ বিচ্ছিন্নতাসহ অন্যান্য খাতে ৩০ শতাংশ অপচয় সমন্বয় করা হলেও তা দাঁড়ায় ১ হাজার ৮১৪ জিবি। এতে প্রতি জিবি ডাটা কিনতে অপারেটরদের ব্যয় হয় সর্বনিম্ন ২২ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৩০ পয়সা, দুটোর গড় করলে যা দাঁড়ায় ২৬ পয়সা।
সেলফোন অপারেটরদের ডাটাভিত্তিক সেবার তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে গ্রামীণফোনের ১ জিবি ডাটার সরাসরি কোনো প্যাকেজ না থাকলেও ফ্লেক্সিপ্ল্যানের মাধ্যমে সমপরিমাণ ডাটা ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। ফ্লেক্সিপ্ল্যানে ৩০ দিন মেয়াদে ১ জিবি ডাটা কিনতে গ্রামীণফোনের গ্রাহকের ব্যয় ২৭৪ টাকা ২৮ পয়সা। একই পরিমাণ ডাটা কিনতে বাংলালিংকের গ্রাহকদের দিতে হচ্ছে ২০৯ টাকা। রবি ও এয়ারটেলের ১ জিবি ডাটা প্যাকেজের মূল্য যথাক্রমে ২১৩ টাকা ৬ পয়সা ও ২০৯ টাকা। তবে এক্ষেত্রে মেয়াদ ধরা হয়েছে ২৮ দিন। আর রাষ্ট্রায়ত্ত সেলফোন অপারেটর টেলিটকের ১ জিবি ডাটা প্যাকেজের মূল্য তুলনামূলকভাবে অন্যদের চেয়ে কম। প্রতিষ্ঠানটির ৩০ দিন মেয়াদি ১ জিবি ডাটা প্যাকেজের মূল্য ১৮০ টাকা। তবে গড় হিসাবে এ পাঁচটি অপারেটরের প্রতি জিবি ডাটার বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ২১৭ টাকা।
দেশে ইন্টারনেট সেবার সম্প্রসারণে গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে ব্যান্ডউইডথের মূল্য কমিয়ে এনেছে সরকার। পাশাপাশি ওয়াইম্যাক্স ও থ্রিজির মতো তারবিহীন উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা চালু করা হয়েছে। ফলে সেবাটির গ্রাহকও বেড়েছে। আর ইন্টারনেট গ্রাহকের সিংহভাগই সেলফোন অপারেটরদের ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করছে। থ্রিজি প্রযুক্তি চালু অপারেটরদের ডাটাভিত্তিক সেবা আরো সম্প্রসারণের সুযোগ এনে দেয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অপারেটররা ব্যবসা করলেও বঞ্চিত হচ্ছে গ্রাহক।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক অপারেটর গ্রুপের (বিডিনগ) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুমন আহমেদ সাবির বলেন, দেশে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথের দাম আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। বিশ্বের অন্যতম সস্তা মূল্য এটি, তাতে সন্দেহ নেই। তবে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের মূল্য কতখানি কমেছে, সেটি বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে মূল্য যেভাবে কমেছে, মোবাইল ইন্টারনেটের মূল্য সেভাবে কমেনি। অপারেটরদের ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য আগের তুলনায় খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। অথচ এ সময়ে কয়েক গুণ বেড়েছে তাদের গ্রাহক। এসব বিবেচনায় দেশে মোবাইল ইন্টারনেট প্যাকেজের দাম গ্রাহক পর্যায়ে আরো সহনীয় করতে হবে।
এদিকে ইন্টারনেট ডাটার মূল্য বাবদ গ্রাহকের কাছ থেকে বেশি অর্থ আদায়ের বিষয়টি মানতে রাজি নয় অপারেটররা। তাদের দাবি, ডাটাভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে যে টাকা নেয়া হয়, তার মাত্র ১-৩ শতাংশ হলো ব্যান্ডউইডথের মূল্য। সিংহভাগ অর্থই প্রতিষ্ঠানের মূলধনি ও পরিচালন ব্যয় সংশ্লিষ্ট। এসব ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে— নেটওয়ার্ক অবকাঠামো নির্মাণ, তরঙ্গ বরাদ্দ, বার্ষিক তরঙ্গ বরাদ্দ ফি ও লাইসেন্স ফি, বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য।
এ বিষয়ে রবি আজিয়াটার ভাইস প্রেসিডেন্ট (কমিউনিকেশন অ্যান্ড করপোরেট রেসপন্সিবিলিটি) ইকরাম কবীর বলেন, প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে কস্ট মডেলিংয়ে দেখা গেছে, ব্যান্ডউইডথের ব্যয় সেবাটির সংশ্লিষ্ট মূলধনি ও পরিচালন ব্যয়ের ১ শতাংশেরও কম। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে এ সেবা দিতে যে ব্যয় হয়, তার তুলনায় ব্যান্ডউইডথের ব্যয় সামান্যই।
তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতি মেগাবাইট ডাটার খুচরা বিক্রয়মূল্য আমাদের ব্যয়ের চেয়ে কম। বাজারে অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতার কারণেই সেবাটির মূল্য এ পর্যায়ে এসেছে। এতে সেবাটি গ্রাহকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এলেও সেবাদানকারী অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের জন্য তা লাভজনক হচ্ছে না।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য বলছে, ফেব্রুয়ারি শেষে দেশে ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা ৬ কোটি ৭২ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে শুধু সেলফোন অপারেটরদের টুজি ও থ্রিজি প্রযুক্তির ইন্টারনেট সেবার আওতায় গ্রাহক রয়েছে ৬ কোটি ৩১ লাখের বেশি। এছাড়া ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার (আইএসপি) ও পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক (পিএসটিএন) অপারেটরদের সেবাগ্রহণকারী ৪০ লাখ ৩৬ হাজার। আর ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রাহক রয়েছে ৮৯ হাজার। দেশে বর্তমানে প্রতি মাসে গ্রাহকপ্রতি ডাটা ব্যবহার হচ্ছে ৪০০-৫০০ মেগাবাইট (এমবি)।
২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত নিলামের মাধ্যমে থ্রিজির তরঙ্গ বরাদ্দ পায় গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেল। পরবর্তীতে একই বছরের ৭ অক্টোবর গ্রামীণফোন, ২১ অক্টোবর বাংলালিংক, ৩০ অক্টোবর রবি ও ৭ নভেম্বর এয়ারটেল বাণিজ্যিকভাবে এ সেবা চালু করে। আর রাষ্ট্রায়ত্ত সেলফোন অপারেটর টেলিটক পরীক্ষামূলকভাবে থ্রিজি সেবাদান শুরু করে আরো এক বছর আগে। ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর সেবাটি চালু করে টেলিটক।
থ্রিজি চালু হওয়ার পর থেকে ডাটাভিত্তিক সেবায় কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে সেলফোন অপারেটররা। গত তিন বছরে অপারেটরদের আয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে ডাটাভিত্তিক সেবা। গত বছর ইন্টারনেট সেবা থেকে শীর্ষ সেলফোন অপারেটর গ্রামীণফোন আয় করেছে ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে খাতটি থেকে প্রতিষ্ঠানটির আয় হয় যথাক্রমে ৫৫০ কোটি ও ৮৫০ কোটি টাকা।
গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন্স সৈয়দ তালাত কামাল এ প্রসঙ্গে বলেন, ডাটা নয়, আইআইজি থেকে ব্যান্ডউইডথ কিনছে গ্রামীণফোন। এরই মধ্যে গ্রামীণফোনের থ্রিজি সেবার আওতায় এসেছে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ইন্টারনেট গ্রাহক।
ইন্টারনেট সেবা থেকে গত বছর ৬৮৪ কোটি টাকা আয় করে সেলফোন অপারেটর রবি। এ সেবা থেকে ২০১৫ সালে ৫২৪ কোটি ও ২০১৪ সালে ২৮৭ কোটি টাকা আয় করে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া বাংলালিংক ডাটাভিত্তিক সেবা থেকে গত বছর আয় করেছে ৪৯১ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ডাটা থেকে প্রতিষ্ঠানটির আয় হয়েছে যথাক্রমে ১৭৬ কোটি ও ৩২৫ কোটি টাকা।
বাংলালিংকের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন্স আসিফ আহমেদ বলেন, গত কয়েক বছরে ইন্টারনেট সেবার দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে বাংলালিংক। ২০০৯ সালে যেখানে প্রতি এমবি ডাটার মূল্য ৩ টাকা ৯০ পয়সা ছিল, তা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ পয়সায়। তিনি বলেন, ডিজিটাল অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে সেলফোনের গ্রাহকরা ফিচারফোন থেকে স্মার্টফোন ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এর ফলে ডাটার ব্যবহারও ক্রমেই বাড়ছে।
বর্তমানে দেশে ব্যান্ডউইডথের চাহিদা প্রায় ৪০০ গিগাবিটস পার সেকেন্ড (জিবিপিএস)। সাবমেরিন কেবল ও ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল কেবল (আইটিসি) সংযোগের মাধ্যমে এ ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ করা হচ্ছে। সাবমেরিন কেবল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল) সরবরাহ করছে ১৩০ জিবিপিএস। আইটিসি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান সামিট কমিউনিকেশন্স ১০০ জিবিপিএস, ফাইবার অ্যাট হোম ৮০ জিবিপিএস, ওয়ান এশিয়া ৪০ জিবিপিএস ও অন্য তিনটি আইটিসি প্রায় ৪০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ করছে। আইআইজি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিএসসিসিএল ও আইটিসির কাছ থেকে ব্যান্ডউইডথ কিনে তা বিক্রি করছে সেলফোন অপারেটর, আইএসপি, পিএসটিএন এবং ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তির সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে।
সূত্রঃ বণিক বার্তা