নিউজ ডেস্ক: ব্যালট ছিনতাই, ককটেল বিস্ফোরণ, ভোটকেন্দ্র দখল ও বিরোধী দলের প্রার্থীদের মারধরের ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ভোটগ্রহণ। বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় সময় ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে শেষ হয় বিকেল চারটায়। সকাল ১১টার দিকে ককটেল বিস্ফোরণ ও কেন্দ্রে ঢুকে বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীকে মারধরের ঘটনায় ২১ নং ওয়ার্ডের সরকারি সিটি কলেজের পুরুষ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। এ সময় কেন্দ্রের বাইরে তিনটি ককটেল ছোড়া হলে একটি বিস্ফোরিত হয় আর বাকি দুটি অবিস্ফোরিত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। ১৫ থেকে ২০ জন কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে ব্যালট পেপারে নৌকা প্রতীকে সিল মারা শুরু করে। এ সময় ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী কাজী মাহবুবুর রহমান ও তার এজেন্ট মো. ফরহাদকে মারধর করা হয়। সেখানে ব্যালট পেপার ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। ঐ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ফরিদ আহম্মেদ জানান, পরিস্থিতির কারণে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। এ বিষয়ে র্যাব ১১ কুমিল্লার কোম্পানি অধিনায়ক মেজর মোস্তাফা কায়জার বলেন, ককটেল বিস্ফোরণের কারণে জনমনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। এরআগে, একই কেন্দ্রে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ব্যালট পেপার নিয়ে দৌড় দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন নিজামউদ্দিন আহমেদ নামের এক ব্যক্তি। পুলিশ প্রথমে তাকে আটক করে। পরে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কান ধরে ওঠবস করিয়ে ছেড়ে দেন। যদিও আইন অনুসারে এই অপরাধের সাজা সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড। এছাড়া দুপুরের দিকে কুমিল্লার নেউরা এন আই হাইস্কুল কেন্দ্রে গোলযোগের কারণে ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া জাল ভোট দেয়ার অভিযোগে ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের চৌরা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়েছে। বেলা দুইটার দিকে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ওই কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করেন বলে জানিয়েছেন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান। চৌরা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনরত একজন পুলিশ সদস্য জানান, আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় পুলিশ সদস্যরা তাদেরকে বাধা দেয়। আর এতে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। পরে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ভোটগ্রহণ স্থগিত করে।
ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা এবং সিটি কলেজের পুরুষ কেন্দ্র ছাড়াও রাজপারা, নেওরায় ৭৪, ৭৫ কেন্দ্র, সুজানগরে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে মাতৃসদন হাসপাতাল কেন্দ্র এবং ৭ নং ওয়ার্ডের ইসহাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রেও দুই পক্ষের উত্তেজনা দেখা গেছে দুপুরের পর থেকে।
এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মণ্ডল বলেন, ‘কিছু কিছু কেন্দ্রে কিছু ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। আর আমরা কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
এরআগে সকাল আটটায় ১০৩টি কেন্দ্রে ভোট শুরুর দেড় ঘণ্টা পর তিনটি কেন্দ্র নিয়ে অভিযোগ করেন বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। তবে তিনি যেসব কেন্দ্র নিয়ে অভিযোগ করেছেন, এর বাইরে অন্য দুটি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত হয়েছে।
এছাড়া দুপুর পৌনে একটার দিকে হঠাৎ করেই দখল হয়ে যায় ৭ নং ওয়ার্ডের গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র। অভিযোগ রয়েছে ‘ওপর থেকে আসা নির্দেশ’ তামিল করতে গিয়ে কেন্দ্রটি হঠাৎ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শূন্য হয়ে পড়ে। আর এ সময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা প্রিসাইডিং অফিসারের কাছ থেকে জোর করে ব্যালট পেপার কেড়ে নিয়ে সিল মারতে থাকে। এ সময় কেন্দ্রটির প্রিজাইডিং অফিসার মো. দিদারুল ইসলামকে জাল ভোট না দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অনুরোধ জানাতে ও ব্যর্থ হয়ে নীরবে কাঁদতে দেখা যায়।
আওয়ামী লীগ প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার ভাই এমরান হোসেনের নেতৃত্বে ২০-২২ জন সমর্থক কেন্দ্রটিতে ঢুকে প্রিজাইডিং অফিসার মো. দিদারুল ইসলামকে জানান, ‘আমাদের ওপর থেকে পাঠানো হয়েছে। আমাদের ঢুকতে দেন।’
কেন্দ্রটিতে ওই সময়ে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভোটার জানান, প্রিসাইডিং অফিসার তাদের দাবিতে সম্মত না হয়ে তাদের বের হয়ে যেতে বলেন। এ সময় তারা প্রিসাইডিং অফিসারসহ ভোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে হুমকি ধামকি দিতে থাকে। ঠিক এসময় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভাই ও স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আফজল খানের ছেলে প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে একটি ফোন ধরিয়ে দেন। ফোনের কথপোকথনের পর প্রিসাইডিং অফিসার দিদারুল ইসলাম হতাশ হয়ে পড়েন আর তার টেবিল থেকে ব্যালট বই নিয়ে ইচ্ছেমতো সিল মারতে থাকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকরা।
এ সময় প্রিজাইডিং অফিসারকে বলতে শোনা যায়, ‘ আই অ্যাম নট সেফ’। তিনি তার টেবিলে বসে এসব ঘটনা দেখে নীরবে কাঁদতে থাকেন।
এ ঘটনার পর জাল ভোট দিয়ে কেন্দ্র থেকে বের হওয়া আওয়ামী লীগের আবদুল খালেক নামের এক কর্মীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে ফোন দিয়ে বলেছেন, ‘আমার নেতাকর্মীদের ঢুকতে দেন কেন্দ্রে।’
এ ঘটনার পর বাইরে বের হয়ে আসা একজন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারকে বলতে শোনা যায়, ‘এই যদি হবে, তাহলে আমাদের এত আশা দিলো কেন?’
এছাড়া দুপুর ১টার দিকে ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের বল্লভপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে রাস্তার পাশে ১০টি ককটেল পাওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেগুলো ঘিরে রাখে।
এ বিষয়ে র্যাব কর্মকর্তা মামুন আবদুল হান্নান বলেন, কে বা কারা পলিথিনে মুড়িয়ে নয়টি ককটেল ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরাতন মহাসড়কে ফেলে রাখে। আরেকটি খোলা পড়ে ছিল। ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
এদিকে বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর নয়াপল্টনে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী।
তিনি অভিযোগ করেন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন সকাল থেকে ধানের শীষের প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। ঢুকলেও বের করে দেয়া হচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবহার করছেন। নির্বাচনকে ঘিরে শাসক দলের সন্ত্রাস চালানোর পাশাপাশি নির্বাচনকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে।
নির্বাচন থেকে বিএনপি সরে যাবে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে রিজভী বলেন, আমরা শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাব এবং সরকারের মুখোশ উন্মোচন করবো।
এ সময় তিনি বলেন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘অনেক কেন্দ্রে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটারদের কাছে নৌকা প্রতীকে ভোট চাচ্ছে পুলিশ’।
কুমিল্লা সিটির ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের শালবন বিহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জাঙ্গালিয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিদ্যালয়, গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থীর এজেন্টদের ঢুকতে বাধা দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
এছাড়া সকালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, যদি কোনো স্থানে দলীয় লোকজন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন তাহলে সেখানেই তাকে বহিস্কার করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন।