সবকিছুতে প্রধানমন্ত্রীকে টানাহেঁচড়া আর কতদিন?

মঞ্জুরুল আলম পান্না: টানা পাঁচটা দিন পুরো দেশবাসীর আতঙ্কগ্রস্ত চোখ ছিল সিলেটের আতিয়া মহলের দিকে, যা ছিল দেশে স্মরণকালের সবচেয়ে দীর্ঘ এবং রক্তক্ষয়ী জঙ্গি বিরোধী অভিযান। আতঙ্কগ্রস্ত কোটি কোটি চোখের সঙ্গে ছিল বুক ভারি নিঃশ্বাসের প্রতিধ্বণি। অবশেষে মঙ্গলবার তার আপাত অবসান। আপাত বলার কারণ, এই অভিযান শেষ হতে না হতেই মৌলভীবাজারে আবারও দুই জঙ্গি আস্তানার সন্ধান। অপারেশন টোয়াইলাইটে সেনাবাহিনী এবং পুলিশ-র‌্যাব’এর সদস্যরা যে পেশাগত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, শুধুমাত্র ধন্যবাদ দিয়ে তাদের ছোট করতে চাই না। ধ্বংসের মুখোমুখি থাকা পাঁচতলা বাড়িটির ভেতর থাকা ২৭ শিশুসহ ৭৮ জনের সবাইকে পুরোপুরি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করতে পারাটা নিঃসন্দেহে এই অভিযানের সফলতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাছাড়া আতিয়া মহলে অবস্থান নেওয়া জঙ্গিরা যে কতটা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং চৌকস তা সেনাসদস্যদের মুখেই উচ্চারিত হয়েছে। ভয়াবহ সেই জঙ্গিদের এমন একটা আস্তানা গুড়িয়ে দিয়ে তাদের দুর্ধর্ষ পরিকল্পনা আর নাশকতার হাত থেকে দেশকে অনেকখানি মুক্ত রাখার বিষয়টিকে তাই ছোট করে দেখারও অবকাশ নেই। তবে অভিযান পরিচালনাকালীন সময় আতিয়া মহলের খুব কাছে র‌্যাব এবং পুলিশের উপস্থিতিতে জঙ্গিদের দুই দফা হামলা এবং তাতে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয় জন মানুষের প্রাণহানিতে অভিযানের সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, একথাও সত্য। সব মিলিয়ে এই অভিযান নিয়ে আরও কিছুদিন হয়তো নানা ধরনের বিশ্লেষণ, আলোচনা-সমালোচনা চলবে।
কিন্তু ঘুরে ফিরে আবারও সেই একটি বিষয় আমাদের সামনে চলে এলো দুর্ভাগ্যজনকভাবে। আমরা জানতে পারলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনার আলোকে জঙ্গিবিরোধী এই কম্বাইন্ড অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছেÑ এখানেও কেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষা? সরকারের বিভিন্ন কাজ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় দিনের পর দিন আমরা দেখছি মন্ত্রণালয়ের ছোট-বড় প্রায় সব সিদ্ধান্ত দিতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত অবশ্যই মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিতে হয়। কিন্তু যে কাজ বা সিদ্ধান্ত দ্রুতগতিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী নিজের মন্ত্রণালয়ে বসে নিতে পারেন, তাও পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে।
নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের সঙ্গে জড়িতদের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া আটক করা হয় না, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার প্রধান আসামি রানাকে আটকের জন্য নির্দেশ দিতে হয় প্রধানমন্ত্রীকে, সড়ক পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে প্রয়োজন হয় সেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের, মালিকপক্ষের সিদ্ধান্তে আশুলিয়ার বন্ধ গার্মেন্টসগুলো খুলতে হয় তারই নির্দেশের পর, বাংলাদেশে সম্প্রচারিত বিদেশি চ্যানেলের বাংলাদেশ ফিডে দেশি বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ হয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে কি হবে না, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ সহায়তা নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের জন্য, এদেশে রাস্তা মেরামতের জন্যও নির্দেশ দিতে হয় প্রধানমন্ত্রীকে। এ রকম আরও কত কি! পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রে সব কাজের জন্য সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতে হয় না। এ কথা আমরা বেশ জানি।
কিন্তু আমাদের কেন এই অবস্থা? সবকিছুতেই কেন প্রধানমন্ত্রীকে নজর দিতে হবে? বিষয়ভিত্তিক এতগুলো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা তাহলে কী করেন? তারা কি নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্যতা বা ক্ষমতা রাখেন না? না কি হিতে বিপরীত কিছু ঘটলে যাতে দায় চাপানো যায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর, অনেকটা সেই চেষ্টা? অথবা প্রধানমন্ত্রীর সুনজরে আসতে, তাকে একটু বেশি সন্তুষ্ট রাখতে এবং নিজের আজ্ঞাবহতার পরিচয় তুলে ধরতে প্রয়োজন ছাড়াও যে যার মতো প্রধানমন্ত্রীর মুখের কথার অপেক্ষায় থাকেন। একজন মানুষের পক্ষে কীভাবে একাধারে এত বিষয়ে প্রতি দৃষ্টি দেওয়া সম্ভব? যদিও আমরা জানি এদেশের শাসনব্যবস্থা এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক, যার অবসান হওয়া প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় মন্ত্রীরা স্বাধীনতা না পেলে কোনো কাজে তাদের জবাবদিহিতাও থাকবে না।
প্রধানমন্ত্রী তো সরকারপ্রধান। সরকারে সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে তিনি দিক-নির্দেশনা দিবেন, সিদ্ধান্ত দিবেন। কখনো কখনো খুব স্পর্শকাতর বড় কোনো বিষয়ে তাৎক্ষণিক অনেক সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষার প্রয়োজন হতেই পারে। তাই বলে সবকিছুতে? জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযানের সম্মতি যে সরকারপ্রধানের সবসময়ই রয়েছে, তা একজন পাগলও জানে। কিন্তু অপরারেশন কী ধরনের হবে, এমন কৌশলগত প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্তের জন্যও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষা?
খুঁটিনাটি সব বিষয়েই যদি প্রধানমন্ত্রীকে মতামত কিংবা সিদ্ধান্ত দিতে হয় তবে রাষ্ট্রের অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে থেকে তার মনযোগ বিচ্যুতি এমনিতেই হবার কথা। এই সংস্কৃতির অবসান হওয়া জরুরি। নইলে প্রধানমন্ত্রীর দোহাই দিয়ে অনেক ক্ষতির কারণ থেকে হয়তো সংশ্লিষ্টরা বেঁচে যাবেন, ক্ষতি যা হওয়ার দেশের হবে, দেশের মানুষের হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

Check Also

এখন সংলাপের সুযোগ নেই

সংবাদবিডি ডেস্ক : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, …