বিদেশ কতো মজার?

নাদীম কাদির : বিদেশকে জেনো মনে করা হয় আলাদীনের চেরাগ? একবার যেতে পারলেই জীবন ধন্য। এক সময় একটা নাটকের লাইন বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, ‘টাকা দেন দুবাই যাব।’ এ যেন স্বর্গতুল্য দেশ, একবার গেলেই জীবন স্বার্থক হয়ে ওঠে। কিন্তু যারা জীবনের তাগিদে যায়, তারা কী স্বর্গের দেখা পায়? মধ্যপ্রাচ্য বলুন আর পশ্চিমা যে কোন দেশ বলুন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র।
অনেকে আমাকে বলেছেন, এর দুই দিক সব দেশেই আছে, মানে ভাল-মন্দ মিশিয়ে। আমি মানলাম, কিন্তু আমি যখন আমার বাংলাদেশের জীবনের সাথে তুলনা করি তখন ট্রাফিক জ্যাম, ধুলাবালি সব মিলিয়ে দেখার পরও আমার জন্মভূমিকেই মনে হয় ভাল।
সাংবাদিকতার স্কলার্সশীপ, ড্যাগ হ্যামারসোল্ড স্কলারশিপ পেয়ে আমি ১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক যাই। এতে আমার সেখানে বেশ কিছুদিন থাকা হয়। সেই স্কলার্সশীপ পাওয়া আমিই একমাত্র বাংলাদেশি সাংবাদিক যে তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পেয়েছি। যাই হোক, তাতেই আমার যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছুদিন থাকা হয়।
জাতিসংঘের পাবলিক অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্টে আমি একবার চাকরির সুযোগ পাই। কিন্তু অনেক চিন্তা করে মা আর মাটির কাছেই মন ছুটে গেল। আমার মাকে জিজ্ঞেস করলাম, থাকব না আসব? মা বললেন, তোমার যা ভাল মনে হয়, তাই করো, কিন্ত আমি একা। বাবাতো মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, ছোট ভাই বড় হচ্ছে।
তারপর নিজের মনকে জিজ্ঞেস করলাম। সেই মাটির আর বৃষ্টির গন্ধ, আয়েশিজীবন আর মার কোল। এসব ভেবে মনে হলো, না এসব ছেড়ে থাকতে পারব না।
১৯৮৫ তে একেবারে দেশেই চলে এলাম।
এবার আমার প্রিয় শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক গুণী সাংবাদিক থাকার পরও আমাকে লন্ডন হাই কমিশনে পাঠিয়েছেন। আমি উনার কাছে অনেক কিছুর জন্যই কৃতজ্ঞ, এটাও সেসবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কৃতজ্ঞতার পাল্লাটা ভারি হয়েই চলেছে।
জীবনে আমার ছোট ছোট কিছু শখ বা ইচ্ছা ছিল, সবই আমি পেয়েছি, উনার কাছে থেকেই পেয়েছি। একজন সুখী মানুষ আমি। মুত্যু হলেও কোনো দুঃখ নাই এখন। থাক সেসব কথা, কারণ সে তো অন্য প্রসঙ্গ।
দেশে কিছুই করতে হয় না, নিজের পেশার কাজটা ছাড়া। ‍কিন্তু বিরক্ত লাগে দুইটা জিনিস, উল্টা-পাল্টা বিদ্যুৎ বিল আসা, বহু বছর ধরে টি অ্যান্ড টি’র লাইন না পাওয়া আর কিছু দুষ্ট লোক যারা নিজেরা জিরো আর অন্যকে জিরো বা খাটো করার জন্য বিভিন্ন কাজ করে থাকেন।
বিদেশে এসব থেকে রেহায় পাওয়া যায়, যদিও খারাপ মানুষ সবখানেই আছে।
এ সব অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, দেশের চেয়ে ভাল কোন জায়গা বুঝি আর কোথাও নেই। অনেকে অবাক হয়, আমি কেনো দেশে থাকতে চাই। যেখানে লন্ডন বা ইউরোপ ছেড়ে কেউই যেতে চাই না, সেখানে আমার কেন এতো দেশপ্রীতি, এ প্রশ্ন আমাকে অনেকেই করে।
বিদেশে নিজের কাজ নিজেই করতে হয়, আড্ডা নাই। একটা যান্ত্রিক জীবন আর সবাই খুব ফর্মাল। মনে হয়, কোথাও কোনো প্রাণের উপস্থিতি নেই। প্রতিদিন অফিসের পরে যদি কোনে প্রোগ্রাম না থাকে, তাহলে সোজা বাসায় চলে যায়। গান শুনে, বই পড়ে, লেখালেখি করেও যেন ঢাকার জীবনের প্রফুল্লতা মিস করি সবসময়।
আমার কিছু প্রিয় মানুষতো আছেই, তারা সরাক্ষণই শুধু বলে তাড়াতাড়ি আসো।
সত্যি কথা বলতে কি, যারা পড়তে এসেই থেকে গেছে তাদের জীবন অনেক কঠিন। চাকরি আর পড়া, দুটো দিক সামাল দিয়ে জীবন চালানো যে কতটা কঠিন সেই অভিজ্ঞতা জীবন দিয়ে যারা না দেখেছে তাদের পক্ষে উপলব্ধি করা মুস্কিল।
অনেকে আবার শেয়ার করে জীবনযাপন করে তাই হয়তো হোমসিকনেস কিছুটা হলেও কম। আর যারা নিজের মতো করে থাকে তাদের ৯৯৯ ছাড়া আর কোনো সঙ্গী নাই, যে কোন ধরণের বিপদ হলে।
যারা বহু বছর ধরে এখানে, বিয়ে করেছেন, বৌ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসবাস করছেন, তারা একটা নিয়মের মধ্যে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তারপরও কিন্ত তারা বলেন, দেশ খুব মিস করি। বেশ ঘটা করে বাঙালিপনা করেন পিঠা উৎসবে, বই মেলায়, নববর্ষে। কিন্তু তাদেরও একটাই কথা, দেশের মতো আনন্দ কোথাও নেই; দেশ-দেশই।
একটা জিনিস স্বীকার করতেই হয়, তাহলো, এসব দেশে কাজের মর্যাদা আছে দেখেই যে কোনো ধরণের কাজ করে জীবন চালানো যায়। কেউ একটু কটূক্তি পর্যন্ত করে না, যা আমাদের বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য একটা বড়ো ধরণের সমস্যা। আমাদের এ ধরণের মন-মানসিকতা পরিহার করতে হবে।
আমার তো ভীষণ ভাল লাগে, যখন দেখি বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছে।
তারপরও আমার শেষ কথা, লেখাপড়া করে চেষ্টা করুন, দেশে এসেই আপনাদের মেধাকে কাজে লাগানোর। কারণ দেশে এখন সুযোগ তৈরি হয়েছে, ভবিষ্যতে নিশ্চয় আরও হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, আপনার অবশ্যই দেশের জন্য কিছু করার দায় রয়েছে এবং আপনার কিছু করার শক্তি সাহস-মেধা সবই রয়েছে, শুধু প্রয়োজন সদিচ্ছা। পরিবর্তন
নাদীম কাদির : সাংবাদিকতায় জাতিসংঘের ড্যাগ হ্যামারসোল্ড স্কলার এবং লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার।

Check Also

বাংলাদেশে অবাধ-সহিংসতামুক্ত নির্বাচন হওয়া উচিত: যুক্তরাষ্ট্র

সংবাদবিডি ডেস্ক : বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার জন্য উন্মুক্ত নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মন্তব্য …