সারাদেশের দৃষ্টি এখন কুমিল্লার দিকে। কারণ একদিন পরেই কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচন নিয়ে এমন ধুন্ধুমার ঘটনার ইতিহাস দেশে একটিও নেই। জাতীয় নির্বাচনের চেয়েও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে এটি। অবস্থা অনেকটা এমনই যে, এই নির্বাচনের মাধ্যমেই হয়ে যাবে সরকার পরিবর্তন। সোমবার মধ্যরাত থেকেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা শেষ মুহূর্তের প্রচার প্রচারণা শেষ করে কুমিল্লা নগরী ছেড়েছেন।
নির্বাচনী প্রচারণা মঙ্গলবার শেষ দিন চৈত্রের বৃষ্টি উপেক্ষা করে কাকডাকা ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সব প্রার্থী ছুটে বেড়িয়েছেন ভোটারের দরোজায় দরোজায়। মঙ্গলবার মধ্যরাতেই শেষ হয়েছে সমস্ত প্রচার-প্রচারণা। এখন কেবল ঘড়ির কাটায় অপেক্ষার পালা, ভোটারেরা কী রায় দেন। কুসিক নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার লক্ষে ১০৩টি ভোট কেন্দ্রের সবগুলোকেই ঝুকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে ২৪ জন করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা রিটানিং অফিসার রকিব উদ্দিন মন্ডল।
নারায়নগঞ্জ নির্বাচনের বিএনপির ভরাডুবির পর এখন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ১৪ দল সমর্থিত আওয়ামীলীগের ‘নৌকা প্রতীকের’ প্রাথী আঞ্জুম সুলতানা সীমা ও বিএনপির প্রার্থী ‘ধানের শীষের’ প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু জয়ে জন্য শেষমুহূর্তে অনেকটা মরিয়া হয়ে উঠেছে। এটাকে তারা মনে করছে, সরকারের জন্য অস্তিত্বের প্রশ্ন। অভিযোগ উঠেছে, সরকার এই নির্বাচনের জন্য প্রশাসনকে ব্যবহার করছে। স্থানীয়-পর্যায়ে সরকারি ও আধা সরকারি বিভিন্ন সংস্থাগুলোর প্রধান এবং সরকারপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করছেন।
এদিকে জয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করছে বিরোধী জোট বিএনপি। কারণ বিএনপি মনে করছে, এই নির্বাচনে ২০ দল সমর্থিত প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু জয়লাভ করলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে। তাই নির্বাচনী মাঠে তারা ছিল সর্বশক্তি নিয়ে। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই পক্ষের অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগের শেষ নেই। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টিতে চরম উৎকণ্ঠা ভোটারদের মাঝেও। দুই পক্ষের মরিয়া চেষ্টায় সাধারণ ভোটাররাও উদ্বিগ্ন। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছেন নতুন দায়িত্ব নেয়া নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসন।
২৭টি ওয়ার্ডে ২ লাখ ৭ হাজার ভোটারের ৫৩.৪ বর্গকিলোমিটার এলাকার কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনে ভোটের দিন সামাল দিতে থাকছে কয়েক ১০ হাজারের বেশি স্তরের নিরাপত্তা বলয়।
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের দ্বিতীয় নির্বাচনে ২ লাখ ৭ হাজার ৫৬৬ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। ২৭টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত দেশের এই অষ্টম সিটি কর্পোরেশনে পুরুষ ভোটারের চেয়ে নারী ভোটার ২ হাজার ৬৭২ জন বেশি। গত নির্বাচনে কুসিকের ভোটার ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ১৭৪ জন। এবারে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭ হাজার ৫৬৬ জনে। এবার ৩৮ হাজার ৩৯২ জন বাড়তি ভোটার এই প্রথমবার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে। তরুণ প্রজন্মের ৩৮ হাজারের বেশি ভোটার জীবনের প্রথম ভোট দিতে কেন্দ্রমুখী হবেন এটাই স্বাভাবিক। তরুণ প্রজন্মের এসব নতুন ভোটার খুশি মনেই ভোট দেবেন তাদের পছন্দের প্রার্থীকে।
কিন্তু তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়ে টেনশনে পড়েছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ১০৩টি কেন্দ্রের ৬২৮টি বুথ কক্ষে এই ভোট অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করার জন্য ১ হাজার ৯৮৭ জন ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকবেন। এর মধ্যে প্রিজাইডিং অফিসার ১০৩ জন, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ৬২৮ জন, পোলিং অফিসার ১ হাজার ২৫৬ জন থাকবেন। নির্বাচনে ১৫৮ জন প্রার্থীর মধ্যে মেয়র পদে ৪ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১১৪ জন এবং সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ৪০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
সিটি করপোরেশন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে পুরো প্রস্তুতি নিয়ে আছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু’দলই। ভোটে হেরফের হলে সংঘাতের আশঙ্কাও আছে নির্বাচনী এলাকায়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ভোট হবে শান্তিপূর্ণ। বিএনপির কর্মীরা ভোট কেন্দ্রে ঝামেলা করতে পারে এমন কথাও বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। মধ্যরাত থেকে বহিরাগতদের কুমিল্লা ত্যাগের কথা বলা হলেও সে সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যেই অতিথি পরিচয়ে বহু বহিরাগত যুবক এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। এছাড়াও ভিআইপি কিছু সরকারি-বেসরকারি রেস্ট হাউসগুলোতেও অবস্থান নিয়ে আছেন অনেকে। সিটি করপোরেশন এলাকা বার্ড, কোটবাড়ী, সুয়াগাজী ফরেস্ট এলাকাসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের হাইওয়ে হোটেলগুলোতে অবস্থান নিয়ে আছেন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা।
এদিকে, কুসিক নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার লক্ষে ১০৩টি ভোট কেন্দ্রের সবগুলোকেই ঝুকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে ২৪ জন করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত করা হচ্ছে। এছাড়াও স্ট্রাইকিং ও মোবাইল ফোর্স হিসেবে প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে মোট ২৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং সংরক্ষিত আসনে একজন করে ৯ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তদারকি করবেন। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রশাসনের এতো সব আয়োজনের মাঝেও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিএনপি। সোমবার দুপুরে দলের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর নেতাকর্মী, সমর্থক ও এজেন্টদের পুলিশ দিয়ে হয়রানি, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার ও হয়রানির অভিযোগ করা হয়েছে।
অপরদিকে, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হওয়ার আশাবাদ ব্যক্তসহ আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা ও দলীয় নেতৃবৃন্দ জয়ের বিষয়ে আশাবাদী।জানা গেছে, নির্বাচনকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে র্যাব-পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ভোটের দুইদিন আগে অর্থাৎ মঙ্গলবার থেকে বহিরাগতদের নির্বাচনী এলাকা ছাড়তে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বুধবার মধ্যরাত থেকে নগরীতে ২৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করার সিন্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
কুমিল্লার আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় ও রিটার্নিং অফিসার রকিম উদ্দিন মন্ডল বলেন- নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে ২৪ জন করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত করা হচ্ছে। এছাড়াও স্ট্রাইকিং ও মোবাইল ফোর্স হিসেবে প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে মোট ২৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং সংরক্ষিত আসনে একজন করে ৯ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তদারকি করবেন।
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ১০৩টি ভোট কেন্দ্রের সবগুলোকেই ঝুকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে কোতয়ালী মডেল থানা এলাকায় ৭২টি ভোট কেন্দ্র এবং সদর দক্ষিণ মডেল থানা এলাকায় ৩১টি ভোটকেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নিত করে প্রতিটি কেন্দ্রে ২৪জন পুলিশ ও আনসার সদস্য এবং র্যাবের ৮ সদস্যের একটি দল দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়াও ঝুকিপূর্ণ দুইটি করে কেন্দ্রতে র্যাব ও পুলিশের আলাদা আলাদা মোবাইল টিম নিয়োজিত থাকবে। এছাড়াও ভোটকেন্দ্রে আসার পথে কোনো ভোটার যেন বাধাগ্রস্ত না হয় তার জন্য র্যাব ও পুলিশের মোবাইল টিম ওয়ার্ডগুলোতে টহলে ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। নির্বাচনী ২৭টি ওয়ার্ডে পুলিশের ২৪ ঘণ্টায় ২৭টি পেট্রল টিম ডিউটি করছে। একটি টিমে ৬ জন করে পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে।
কুমিল্লাস্থ র্যাব-১১ এর অধিনায়ক মেজর মোস্তফা কায়জার জানান, র্যাবের ৩৩৮ জন সদস্য এ নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করছে। ভোটের দুইদিন আগে থেকে এবং নির্বাচনের পরদিন পর্যন্ত টানা চারদিন ২৭টি ওয়ার্ডে ৮ জন করে ২১৬ জন সদস্য মোতায়েন থাকবে। অপর সদস্যরা সাদা পোশাকে নজরদারিসহ স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।
শেষ দিনের প্রচারণা :
নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিনে মঙ্গলবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকা মুখরিত ছিল ৪ মেয়র, ১০৪ সাধারণ কাউন্সিলর ও ৪০ নারী কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের কর্মব্যস্ত পদচারণায়। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে মিছিলে-মিটিংয়ে স্লোগান আর শোডাউনে সয়লাব ছিল পুরো এলাকা। রাত ১২টা পর্যন্ত সদলবলে প্রচারণা চালিয়েছেন সকলে। এদিনের অর্ধেক ভাগ জুড়ে ছিল মুষলধারায় বৃষ্টি। প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন প্রার্থীরা। ভোট চেয়েছেন, দোয়া চেয়েছেন। মুরব্বিদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছেন।
কোন কোন প্রার্থী অতীতের ক্রিয়াকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনে মেয়র প্রার্থী ৪ জন হলেও বাস্তবে মাঠে আছেন ২ জন। ১৪ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলমানা সীমা (নৌকা প্রতীক) এবং ২০ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সদ্য বিদায়ী মনিরুল হক সাক্কু। বাকি ২ প্রার্থী জাসদ প্রার্থী শিরিন আক্তার, স্বতন্ত্র প্রার্থী মেজর (অব.) মামুনুর রশিদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তারা কোন আলোচনাতেই নেই।
বিএনপির মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু বলেছেন, আমি শুরু থেকে বলে আসছি আজও আপনাকে বলছি, আমি নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পাচ্ছি না। সরকারি দল প্রশাসনের সহায়তায় নানাভাবে আমাকে হয়রানি করার চেষ্টা করে আসছে। আমার সবচেয়ে দুঃখ হলো আমার নিরীহ কর্মীদের ওপর হামলা করা হচ্ছে, হয়রানি করা হচ্ছে।
অভিযোগের বিষয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করা আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা বলেন, বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর অভিযোগ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। নিজের পরাজয় আঁচ করতে পেরেই এতসব কথা বলছে। বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার জনগণের সরকার। দেশের উন্নয়ন দেখে বিএনপি তথা ২০দলীয় জোট অযথা বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছে। কুমিল্লায় নৌকার জোয়ার বাইছে। নৌকার বিজয় নিশ্চিত।