একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমরা অনেককেই বন্ধু হিসেবে পাশে পেয়েছি। আমাদের গৌরবময় অধ্যায়ের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আমরা পেয়েছিলাম ভিনদেশী কিছু মমতাময় মানুষকে। সেইসব দরদী বন্ধুদের নামগুলো আজও আমাদের মনে পড়ে।
জর্জ হ্যারিসন এণ্ড ফ্রেণ্ডস
আগস্ট, ১৯৭১ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরের ম্যাসিডন স্কয়ার। সেখানে চলছে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। অপ্রতিরোধ্য বীর বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিট্লসের জর্জ হ্যারিসন গাইলেন, ‘বাংলাদেশ…বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই গানটি। উদ্দেশ্য ছিল, বাঙালি শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য অর্থ-তহবিল গঠন করা। তার সঙ্গে ছিলেন সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশংকরসহ আরো অনেকে। একাত্তরের দিনগুলোই ছিল এমন।
মার্কিন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন
শিশুর লাশ নিয়ে কুকুর আর শকুনের কাড়াকাড়ি, সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নীরিহ জনগণকে হত্যা, শতবর্ষী বৃদ্ধার গড়িয়ে-গড়িয়ে সীমান্তের ওপারের নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে কান্তিহীন চলা, গুলিবিদ্ধ লাশের স্তূপ, মানবেতর শরণার্থী শিবির, পুড়িয়ে দেয়া ঘরবাড়ি, মাতৃভূমির মুক্তির জন্য গেরিলাদের শপথ, পতাকা ওড়ানো, গানবোটে গেরিলা যুদ্ধ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের দেশাত্ববোধক গান, জয়বাংলা স্লোগানে মুখরিত হাজারো মানুষ- এসব ১৯৭১-এর বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্র। যা গাঁথা আছে সেলুলয়েডের রুপালি ফিতায়।
তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের ‘মুক্তির গান’ ও ‘মুক্তির কথা’। এসব প্রামাণ্যচিত্রের বেশিরভাগই সরাসরি যুদ্ধত্রে থেকে শুটিং করা। কিছু নির্মিত হয়েছে নিউজ রিল থেকে। মার্কিন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিনের ধারণ করা ফুটেজ সংগ্রহ করে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মাণ করেন ‘মুক্তির গান’। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের এসব প্রামাণ্যচিত্র আসলে প্রামাণ্য দলিল।
টেড কেনেডি
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশে যখন গণহত্যার মহোৎসব চলছে, তখন একজন ডেমোক্র্যাট দলীয় সিনেট সদস্য জনপ্রিয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন. এফ কেনেডির কনিষ্ঠ ভ্রাতা টেড কেনেডি পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখার জন্য তিনি পূর্ব-পাকিস্তানে আসতে চাইলেন, কিন্তু পাক সরকার তাকে এদেশে আসার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানালো।
অগত্যা তিনি এলেন পশ্চিম বাংলায়, ঘুরে ঘুরে দেখলেন শরণার্থী শিবিরগুলো। এভাবেই তিনি জানলেন কি মর্মান্ত মানবিক বিপর্যয় ঘটে চলেছে বাংলাদেশে। দেশে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে একটি মর্মস্পর্শী দীর্ঘ প্রতিবেদন সিনেটে উপস্থাপন করলেন এবং এই অমানবিক কর্মকাণ্ডে পশ্চিম পাকিস্থানী সামরিক জান্তা সরকারকে সমর্থন দানের মার্কিন নীতির তীব্র সমালোচনা করলেন।
ফরাসি লেখক আঁদ্রে মালরোক
স্মরণ করতে হয়, ফরাসি লেখক আঁদ্রে মালরোকে, যিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করে এ দেশকে আপন করে নিয়েছিলেন। মালরো লিখেছিলেন, “বিদ্রোহ যখন শুরু হলো, তখন থেকে ইসলামাবাদের সেনারা পূর্ব বাংলার কাছে আর স্বদেশবাদী বা স্বধর্মীয় থাকল না, তারা পরিণত হলো দখলদার বাহিনীতে।”
অ্যালেন গিন্সবার্গের অসাধারণ সেই কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কি এখনও আমাদের আত্মাকে আন্দোলিত করেনা?
‘লক্ষ শিশু দেখছে আকাশ অন্ধকার/ উদর স্ফীত, বিস্ফোরিত চোখে জলধারা/ যশোর রোডে বিষন্ন সব বাঁশের ঘর/ ধুঁকছে শুধু, কঠিন মাটি নিরুত্তর।’
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকান কবি ‘অ্যালেন গিন্সবার্গ’ লিখেছিলেন সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড কবিতাটি। যার আলোকে মৌসুমী ভৌমিক গেয়েছিলেন বিখ্যাত ‘যশোর রোড’ গানটি।
সাংবাদিক সাইমন ড্রিং
একাত্তরে সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের বয়স মাত্র ২৭ বছর। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর সংবাদদাতা। কঠোর পাহারার মধ্যেও তিনি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছিলেন পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ।
২৫ মার্চ সন্ধ্যায় তৎকালীন ইন্টারকন্টিনেন্টালে নজরবন্দী ছিলেন সাইমন ড্রিংসহ চল্লিশ জন বিদেশি সাংবাদিক। ২৭ মার্চ ঢাকার রাজপথে বের হন তিনি। ধ্বংসপ্রাপ্ত রক্তাক্ত ঢাকা শহর দেখে শিউরে ওঠেন তিনি। ব্যাংককে ফিরে প্রকাশ করেন ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান’। প্রকাশ করেন সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, দগ্ধ শহর, লাশের পাহাড়, হাজার হাজার মানুষের পালিয়ে যাওয়ার খবর।