হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত : বঙ্গবন্ধু

নিউজ ডেস্ক
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়। তাদের পরিকল্পনা ছিল, ১৯৭০ এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগকে কেবল উৎখাতই নয় একই সঙ্গে বাঙালি সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, ইপিআর এবং ছাত্রজনতাকে নিধন করা। ওই রাতেই গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

২৫ মার্চের ওই কালরাতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক সাইমন ড্রিং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (পরবর্তীতে হোটেল শেরাটন, বর্তমানে হোটেল রূপসী বাংলা) অবস্থান করছিলেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেন-

‘সেদিন শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করি। মুজিব আমাদের বলেছিলেন, তিনি আত্মগোপন করবেন না। কারণ তেমন কোনো কিছু হলে জনগণের ওপর অত্যাচার নেমে আসতে পারে। আমরা যখন শেষবারের মতো শেখ মুজিবের সঙ্গে যোগাযোগ করি তখন মধ্যরাত। তিনি আমাকে বলেন, তার বাড়ি থেকে তিনি সবাইকে বিদায় করে দিয়েছেন। রেখেছেন শুধু তিনজন গৃহকর্মী ও নিরাপত্তাকর্মী। যেন তিনি প্রস্তুত হয়ে পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পরে তার এক প্রতিবেশীর কাছে শুনেছি রাত ১:১০টায় একটি ট্যাংক, একটি অস্ত্রসজ্জিত কার ও এক ট্রাকভর্তি সৈনিক বাড়িটির দিকে এগিয়ে আসে ফাঁকা গুলি করতে করতে। সৈন্যবহর বাড়িটির বাইরে এসে থামলে একজন অফিসার ইংরেজিতে ডাক দিল, শেখ সাহেব, আপনি বেরিয়ে আসুন। এ আহ্বানের জবাবে তিনি ব্যালকনিতে বেরিয়ে এলেন এবং বললেন, হ্যাঁ। আমি প্রস্তুত। কিন্তু গুলিবর্ষণের কোনো প্রয়োজন নাই। টেলিফোনে আহ্বান করাই যথেষ্ট ছিল। আমি নিজে গিয়ে হাজির হতাম। এরপর অফিসারটি বাড়ির বাগানের মধ্যে হেঁটে গিয়ে বললেন, আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। দেহরক্ষীকে বেদম প্রহার করা হলে তিনি (বঙ্গবন্ধু) অফিসারটিকে গালি দিতে শুরু করলেন। পার্শ্ববর্তী বাড়ির নৈশপ্রহরী প্রাচীরের আড়ালে লুকাতে গেলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।’

তিনি (সাইমন ড্রিং) আরও উল্লেখ করেন, ‘শনিবার সকালে আমি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গেলাম। দেখলাম সেখানে কোনো আর্মি বা নিরাপত্তা বাহিনীর লোক নেই। পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে। আমি বাড়ির আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বললাম। তারা আমাকে আগের রাতের ঘটনা জানাল। আমি জানতে পারলাম, মুজিব পুরোপুরি সুস্থ। তিনি আহত বা নিহত নন। তাকে বন্দী করা হয়েছে।’

পরবর্তীতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, ২৫ মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বর শেখ মুজিবের বাসভবনে পাকিস্তানি সাংবাদিক তারিক আলীর পিতা মাজহার আলী এবং রেহমান সোবহান শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেন এবং তাকে জানান মিলিটারি ক্রাকডাউন আসন্ন। [সূত্র: বাংলাদেশের অভ্যুত্থান এবং একজন প্রতক্ষ্যদর্শীর ভাষ্য , রেহমান সোবহান , ভোরের কাগজ প্রকাশনী , ১৯৯৪]

শেখ মুজিব এরপর ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকেন এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একজন সংবাদবাহক স্থানীয় এবং বিদেশি সাংবাদিকদের মাঝে একটি প্রেসনোট বিলি করেন যেটিতে উল্লেখ করা হয়, “প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনা চূড়ান্ত হয়েছে, ক্ষমতা হস্তান্তরের মতানৈক্য হয়েছে এবং আমি (শেখ মুজিব) আশা করি প্রেসিডেন্ট তা ঘোষণা করবেন”। এ বিষয়ে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বলেন: “আমার দুঃখ হয়, এই নির্বুদ্ধিতা সম্পর্কে আমার কোন মন্তব্য নেই”। [সূত্র: রেপ অব বাংলাদেশ , অ্যান্থনি মাসকারেনহাস, অনুবাদ মযহারুল ইসলাম, ১৯৭৩ , পৃষ্ঠা:১১৩]

২৫ মার্চ ইয়াহিয়া এবং ভুট্টোর ভেতর ৪৫ মিনিটের ১টি মিটিং হয়। শেখ মুজিব পূর্বঘোষণা অনুযায়ী ২৫ মার্চে ইয়াহিয়ার ভাষণের জন্য অপেক্ষা করেন। সন্ধ্যা ৬টায় ইয়াহিয়া করাচীর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। তার এই ঢাকা ত্যাগের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন দু’জন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা। ১. ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে এটি প্রত্যক্ষ করেন লে. কর্নেল এ. আর চৌধুরী এবংবিমানবন্দরে এটি প্রত্যক্ষ করেন এয়ারফোর্সে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খোন্দকার। শেখ মুজিব তখনও একটি ফোনকলের অপেক্ষায় ছিলেন এবং ডক্টর কামাল হোসেনকে বার বার জিজ্ঞেস করছিলেন কোন ফোন এসেছে কিনা। প্রতিবারই ডক্টর কামালের উত্তর ছিল না সূচক। ফোনটি আসার কথা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেনেন্ট জেনারেল পীরজাদার কাছ থেকে।কারণ ইয়াহিয়া বলেছিল তার ভাষণ প্রচারের আগে পীরজাদার সাথে শেখ মুজিবের একটি ছোট বৈঠক হবে। সেই ফোনকল আর আসেনি কোনদিন। শেখ মুজিবও বুঝতে পারেন সব আশা শেষ। ইয়াহিয়া ধোঁকা দিয়েছে। [সূত্র : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, জীবন ও রাজনীতি , ১ম খণ্ড , সম্পাদক মোনায়েম সরকার, বাংলা একাডেমী ২০০৮, পৃষ্ঠা:৪৪৭]

রাত ৮টার দিকে এ রকম একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে এইচ এম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী , তাজউদ্দীন আহমদ এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম শেখ মুজিবের সাথে দেখা করে চলে যান। শেখ ফজলুল হক মনি ২৫ মার্চ সন্ধ্যায়ই টুঙ্গিপাড়া চলে যায় এবং শেখ কামাল রাত ৯টায় ধানমন্ডি ৩২নং ছেড়ে যান। [সূত্র : শেখ মুজিব , এস.এ. করিম, ইউপিএল, ২০০৫, পৃষ্ঠা ১৯৫]

রাত ৯টার দিকে ডক্টর কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ৩২নং বাসা থেকে বিদায় নেন। রাত ৯টা ১০ মিনিটের দিকে ঠিক এই সময়েই প্রথমবারের মত গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন জানান রেহমান সোবহান। [সূত্র : প্রাগুক্ত]

রাত সাড়ে ১০টার দিকে ইস্ট পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনের ম্যানেজেং ডিরেক্টর ক্যাপ্টেন রহমান এবং ২ জন এক্স নেভাল অফিসার কমান্ডার ফারুক এবং লেফটেনেন্ট মতিউর রহমান দেখা করতে আসেন শেখ মুজিবের সাথে। এ সময় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ প্রধান আব্দুর রাজ্জাক এর কাছ থেকে ১টি ফোন আসে শেখ মুজিবের কাছে। “ইপিআরকে ডিসআর্মড করা হয়েছে” শেখ মুজিব কে এতটুকু বলতে না বলতে লাইন কেটে যায়। [সূত্র : শেখ মুজিবের বাসভবনে সে সময় অবস্থানরত পারিবারিক কর্মচারী মমিনুল হক খোকা, প্রাগুক্ত , পৃষ্ঠা – ৪৪৭-৪৮]

রাত ১১টায় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ প্রধান আব্দুর রাজ্জাক শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাত করে তাকে আত্মগোপন করার অনুরোধ জানান। শেখ মুজিব সরাসরি তাকে জানিয়ে দেন, তিনি বাসা ছেড়ে যাবেন না। সূত্র : আর্চার ব্লাড, দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ, ইউপিএল, ২০০৬, পৃষ্ঠা ১৯৮]

রাত সোয়া ১১টার দিকে সিরাজুল আলম খান, আ.স.ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ তারা সবাই শেখ মুজিবের সাথে দেখা করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসা ত্যাগ করেন। শেখ হাসিনার স্বামী ডক্টর ওয়াজেদ মিয়ার বক্তব্য অনুসারে এটাই ছিল শেখ মুজিবের সাথে ওই রাতে তাদের শেষ বৈঠক।

ডক্টর ওয়াজেদ মিয়ার বক্তব্য অনুসারে জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা জাকারিয়া চৌধুরীর ভাই ঝন্টু ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবের বাসায় আসেন রাত সাড়ে ১১টার দিকে। শেখ মুজিবকে অপারেশন সার্চলাইট এবং নির্বিচার গোলাগুলির খবর জানান ঝন্টু। ঝন্টুর মাধ্যমে পরিস্থিতি অবগত হয়ে শেখ মুজিব তার কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এবং জেলীকে ১টি ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দেন আত্মগোপন করার জন্য। শেখ মুজিবের পরিবারের সদস্যদের আত্মগোপনের জন্য আগেই ওই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয়া হয়েছিল। ওয়াজেদ মিয়া নিজেও রাত সাড়ে ১১টার পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ত্যাগ করেন। [সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, ইউপিএল, ২০০০, পৃ ৮৪]

“২৫ মার্চ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শেখ মুজিবের বাসায় ছিল মানুষের ঢল। কিন্তু ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর প্রকাশ হয়ে পড়ায় এবং সেনাবাহিনীর মতিগতি দেখে সন্ধ্যার পর থেকেই ঢাকার সর্বত্র বাড়তে থাকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এ পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে বিভিন্নস্থানে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে হরতাল আহ্বান করেন।” [ সূত্র : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব , জীবন ও রাজনীতি, ১ম খণ্ড, সম্পাদক মোনায়েম সরকার, বাংলা একাডেমি ২০০৮, পৃষ্ঠা:৪৪৭]

Check Also

বিদেশে নয় দেশের মাটিতেই বিয়ের পরিকল্পনা রকুল-জ্যাকির

সংবাদবিডি ডেস্ক ঃ রকুল প্রীত সিং ও জ্যাকি ভাগনানির বিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি। বিয়ের প্রস্তুতি এখন …