ডেস্ক রিপোর্ট: ডিভোর্স। ডিভোর্সের কারণেই ক্ষিপ্ত হয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা আরিফুন নেছা আরিফাকে হত্যা করেছে তার সাবেক স্বামী। পরিকল্পিতভাবেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। সাত মিনিটের মধ্যেই কিলিং মিশন সম্পন্ন করে পালিয়ে যায় তার সাবেক স্বামী ফখরুল ইসলাম রবিন। একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে এই দৃশ্য।
রবিনের কল পেয়েই বাসা থেকে বাইরে এসেছিলেন আরিফুন নেছা। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে ফোনে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছেন তিনি। ঘড়িতে তখন সকাল ৮টা ৪৪ মিনিট। তার কয়েক মিনিট পরেই একটি নীল ব্যাগ, ফ্যান, রান্নার পাতিলসহ কিছু মালপত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকছিলেন আরিফা ও তার সাবেক স্বামী রবিন। ৮.৫১ মিনিটে রবিনকে দৌড়ে বের হতে দেখা গেছে ওই ফুটেজে।
ওই বাড়ির বাসিন্দা তাসমিন নূর জানান, তিনি তখন ঘুমে ছিলেন। হঠাৎ চিৎকার। পরপর তিন বার ‘মা, মাগো… ওমা…’ বলে চিৎকার করছিলেন। চিৎকার শুনে বাইরে বের হন তাসমিন নূর। দেখতে পান সিঁড়ির পাশে পড়ে আছেন রক্তাক্ত আরিফুন নেছা। তাৎক্ষণিকভাবে বাসার দারোয়ান ও আশপাশের লোকজন এগিয়ে যায়। তাসমিন নূরের মাধ্যমে ফোনে খবর পেয়ে যান আরিফনু নেছার খালাতো ভাইয়ের স্ত্রী। যিনি তাদের প্রতিবেশী। প্রথমে সেন্ট্রাল হাসপাতাল পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১১টা ৪০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, সিঁড়ির পাশেই হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে। ওই স্থানটি সিসি ক্যামেরার আওতায় না থাকায় ছুরিকাঘাতের দৃশ্যটি তাতে দেখা যায়নি। ঘটনাস্থল থেকে রক্তমাখা ধারালো অস্ত্রটি জব্দ করেছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত বলেই ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। সূত্রমতে, ডিভোর্সের পর থেকেই স্ত্রীকে ফিরে পেতে ব্যাকুল হয়ে উঠে রবিন। কিন্তু আরিফুন নেছা কোনোভাবেই রবিনকে সেই সুযোগ দেন না। ব্যাংকে আসা-যাওয়ার পথে
তার সঙ্গে কথা বলতে চাইতো রবিন। কিন্তু তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন আরিফুন নেছা।
এ নিয়ে রাস্তায় দু’জনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়েছে একাধিকবার। আরিফুন নেছার বড় ভাই আল আমিন বুলবুল জানান, রবিন তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিতো। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন তার বোন। কিন্তু তারপরও আরিফুন নেছার শেষ রক্ষা হয়নি। তবে জিডির বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। আদৌ জিডি করা হয়েছিল কি-না তা খুঁজে দেখা হচ্ছে বলে কলাবাগন থানা পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সূত্রমতে, জামালপুরের মেয়ে আরিফুন নেছা ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী ছিলেন। জামলাপুরে থাকাকালীন একই জেলা শহরের বাসিন্দা রবিনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে আরিফুন নেছার। বেশিদূর লেখাপড়া হয়নি রবিনে। পরে দুজনেই ঢাকায় আসেন। ঢাকায় আসার পর দু’জনের সম্পর্ক আরো গভীর হয়। ঢাকায় একটি টেলিকম সংযোগ কোম্পানির এক ডিলারের সেলস বিভাগে চাকরি করতো রবিন। ২০১৩ সালে পরিবারের অমতেই প্রেমিক রবিনকে বিয়ে করেন আরিফুন নেছা।
বিয়ের পরে রবিনের সঙ্গে বাড্ডার বাসায় উঠেন তিনি। এর মধ্যেই ব্যাংকে চাকরি হয় আরিফুন নেছার। বিয়ের কয়েক মাস পরেই তাদের মধ্যে শুরু হয় কলহ। আরিফুন নেছার স্বজনরা জানান, বিয়ের পরে আরিফা জানতে পারেন রবিন মাদকাসক্ত। শারীরিক-মানসিকভাবে নির্যাতন করতো রবিন। একপর্যায়ে বাসা ছেড়ে মহিলা হোস্টেলে উঠেন। গত বছরের আগস্টে স্বামী রবিনকে ডিভোর্স দেন তিনি। তারপর থেকে মা আফিফা জামানকে নিয়ে কলাবাগান থানা এলাকার সেন্ট্রাল রোডের ভাড়া বাসায় থাকতেন।
সূত্রমতে, ডিভোর্সের পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠে রবিন। কোনোভাবে এই ডিভোর্স মেনে নিচ্ছিল না। হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন আগে মতিঝিলে যমুনা ব্যাংকে গিয়ে আরিফুন নেছার সঙ্গে কথা বলেছিল রবিন। ওই সময়ে আরিফুন নেছাকে বলেছিল আগের বাসায় আরিফুন নেছার কিছু জিনিসপত্র রয়েছে। তা ফেরত দিতে চায় সে। দিনক্ষণ নির্ধারণ করেই বৃহস্পতিবার সকালে এসব জিনিসপত্র নিয়ে সেন্ট্রাল রোডের ওয়েস্ট এন্ড স্ট্রিটের ১৩/এ বাড়িতে যায় রবিন।
ওই বাড়ির নিচতলায় মাকে নিয়ে সাবলেট থাকতেন আরিফুন নেছা। ঘটনার কয়েকদিন আগে তার মা ছেলের বাসা আশকোনায় গিয়েছিলেন। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা জিনিসপত্র দেয়ার নাম করে হয়তো আরিফুন নেছার কক্ষে ঢুকতে চেয়েছিল রবিন। রুমে ঢুকতে না পেরে বাইরেই তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। আরিফুন নেছার পেছনে ঘাড়ে উপর্যুপরি আঘাত করা হয়েছে। তিনি হয়তো নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। এ সময় তার দুটি হাতেও ছুরির আঘাত লেগেছে।
নিহত আরিফুন নেছা আরিফা (২৭) যমুনা ব্যাংকের কার্ড ডিভিশনের একজন মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ ছিলেন। তিনি জামালপুর জেলার মেলান্দহ থানার হাজরাবাড়ির মৃত আনিসুজ্জামানের মেয়ে। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। এ ঘটনায় আরিফুন নেছার সাবেক স্বামী ফখরুল ইসলাম রবিনকে আসামি করে কলাবাগান থানায় গতকাল হত্যা মামলা করেছেন তার বড় ভাই আব্দুল্লাহ আল-আমিন। ফখরুল ইসলাম আলমগীর জামালপুর জেলা সদরের সকালবাজারের বাজারীপাড়া এলাকার মৃত আমিরুজ্জামানের ছেলে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কলাবাগান থানার পরিদর্শক সমির চন্দ্র সূত্রধর বলেন, ডিভোর্সের কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া গেছে। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। যে বাড়িতে আরিফুন নেছা থাকতেন ওই বাড়ির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়া গেছে। সবকিছু মিলিয়ে হত্যাকারী রবিন বলেই নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাকে গ্রেপ্তার করতে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার ও সোর্সের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। শিগগিরই তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি। সূত্র : মানব জমিন